জেনিস আক্তার :
আমার গ্রাম আগের মতোই সবুজে ঘিরে আছে বরং এখন আরো বেশী সবুজ হয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন রুপ রসের ঘাটতি, কোথায় যেন প্রাণ নেই, কোথায় যেন হাহা শূন্যতা ।
এবার ঈদে বাড়ি গিয়ে দেখলাম এবং জানলাম মাদকতায় পুরো গ্রাম আচ্ছন্ন। তেরো বছরের এক ছেলের কাছে গাজার স্টিক পেলেই বুঝা যায় মাদক কত সহজ হয়ে ধরা দিয়েছে। আচ্ছা আমাদের সময়ে কি এতোটা বেশীই মাদক ছিলো? আমার তো মনে হয় মুশুদ্দি বাজারের কাছে মুচি বাড়ি ছাড়া কোথাও বাংলা মদ পাওয়া যেত না আর অন্য কোথাও কেউ নেশাও করতো না। আমি খুব বেশী সময়ের আগের কথা বলছি না, নিজের চোখেই দেখেছি। তিরানব্বইয়ে এই আমার জন্ম হওয়া চোখই দেখেছে এসব। লোকমুখে শোনা কথা না। তিরানব্বইয়ে জন্ম হলে বুঝে দেখার মত চোখ হয়েছিল বড়জোর আজ থেকে দশ বছর আগে। হ্যাঁ দশ বছর আগের কথাই বলছি।
এখনকার মুশুদ্দি গ্রামে আড্ডার আসরই হচ্ছে নেশার জায়গা। আর এই আড্ডাটা দিচ্ছে গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাসরত যুবক। এদের বয়স কারোর আঠারো পার করবে না। আর এই যুবকদের সাথে আড্ডায় সামিল হয়ে সৌজন্যতাবোধ রক্ষা করতে গিয়ে সচেতন কেউ কেউ গাঁজা কিংবা মাদকের ঘ্রাণ নিতে কার্পণ্য করছে না।
কোথা থেকে এতো সহজভাবে মাদক পায় তারা? আর মাদক কারাই বা এতো সহজে হাতে তুলে দিচ্ছে? প্রসাশন কি করছে? নাকি প্রশাসনই এর মূল উদ্যোক্তা? প্রশ্ন থেকে যায় সেই সাথে এইসব প্রশ্ন তুলে নিজেও হুমকির মুখে পরার মত অবস্থা হয়।
গ্রামটায় বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ, পরকিয়া, নারী নির্যাতন বেড়েই যাচ্ছে। সচেতন করার মত কেউ নেই।
আচ্ছা সিক্স সেভেন পড়ুয়া মেয়েদের যদি বিয়েই হয়ে যায় তবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মুশুদ্দি রেজিয়া কলেজে পড়বে কারা? কলেজ করার সাথে বাল্য বিবাহ রোধটাও জরুরী না? আমি মনে করি একটা গ্রামের উন্নতি কিংবা প্রগতি নির্ভর করে ছেলেমেয়ে উভয়ের উপরেই। একটা মেয়েকে কোন রকমে ক্লাস নাইন পর্যন্ত নিয়ে গেলে তাদের স্বপ্ন বড় হয়। তারা উচ্চ শিক্ষা নিতে আগ্রহী হয়। কিন্তু সে পর্যন্ত যেতে দেয় কে? একটা ক্লাস সেভেন পড়ুয়া মেয়ে কি বুঝে তার জীবনের? বিয়ের পিঁড়িতে বসে পাটিটাও জড়িয়ে ফেলে নিজের সাথে। মেয়েগুলোরই বা কি করার থাকে? কারণ সেও তো নির্ভরশীল তার মা বাবার উপর। মেয়েকে সচেতন না করে মা বাবাকে সচেতন করা খুব বেশী জরুরী। তাদের মা বাবা মনে করে- মেয়ের এই সময় যেমন ভালো বিয়ে আসছে পরে আর আসবে না এই চিন্তায় মেয়ে বিদায় করার চিন্তা থাকে অহর্নিশ।
পরবর্তীতে ছোট্ট মেয়ে না বুঝে সংসার, না বুঝে শ্বশুড় শ্বাশুড়ী না বুঝে দেবর ননদ। তখন পারিবারিক কলহ বাঁধে জোরালো ভাবে। যখন মেয়ে বড় হয় বুঝে নিজের জীবন নিজের স্বাধীনতা তখন স্বামীর সাথে চলে সংঘাত। কারণ স্বামী বেচারা তার প্রাণপ্রিয় বউমনির কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সংসার শান্তি না পেয়ে ততোদিনে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আবেগ, সম্মান সব ধূলোয় উড়িয়ে দিয়েছে। আর বউমনিরও সহ্য হচ্ছে না স্বামী বেচারাকে। ফলাফল গড়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ, নির্যাতন, আর পরকিয়া।
আমি এবার গ্রামে গিয়ে আমাদের এলাকার কাজী সাহেবের সাথে কথা বলেছি, কিছু গণ্যমান্য যারা সচেতন তাদের কাছে জানতে চেয়েছি এসব কেন? তাদের কথা শুনে আমি পুরোই থ বনে গিয়েছি । তাদের এক জরিপে তারা জানিয়েছি মাসে যদি একটা বিবাহ কাজ সম্পন্ন করেন তাহলে গড়ে মাসে তারা তিনটা বিয়ে বিচ্ছেদ করেন এই সব নির্যাতন, বহুবিবাহ ও পরকিয়ার জন্য।
ভাবতেই কান্না আসে এই আমার গ্রাম?
ছেলেদের কথায় আসি, ছেলেরা টেকনিক্যাল লাইন থেকে বিশ বছর বয়সে একটা সার্টিফিকেট অর্জন করেছে, কোন রকম দশ বারো হাজার টাকার চাকরি করছে দুই বছর ধরে। এই দুই বছর চাকরি যোগ্য ছেলেকে বিয়ে করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তাদের মা বাবা। আর ছেলেদের কথা বাদ ই দিলাম। তাদেরো পছন্দ থাকছে কিংবা মা বাবার পছন্দ করা মত ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে করে অনায়াসে তিন চার লক্ষ টাকার সাথে ফ্রি পাচ্ছে গহনা। এ সুযোগ কে হাত ছাড়া করে?
কিন্তু বিয়ের এক বছরের মাথায় সব হতাশা ভর করছে মাথায়। ছেলে এবং তার নতুন সংসার নিয়ে ভরাডুবিতে তখন। সাথে আসে একটা নতুন মুখ। উফ ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠে। জীবন তখন আর তিন চার লক্ষ টাকা কিংবা দশ বারো হাজার টাকার চাকরির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, এর সাথে বাড়তি যোগ হয় ছোট ভাই বোন য়ার মা বাবার চাওয়া পাওয়া।
জীবন কোথায় যায় তখন?
মুশুদ্দি গ্রামে অপসংস্কৃতি ঢুকে গেছে এটা আমি বলব না, কারণ সেখানে কোন সংস্কৃতির চর্চা হয় না, অপসংস্কৃতি আসবে কোথা থেকে?
সুস্থ সংস্কৃতি মানুষকে উন্নত ভাবনা দান করে, মুশুদ্দি গ্রামে মুশুদ্দি স্কুল এর সৌজন্যে একটা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছাড়া কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারীতে খালি পায়ে প্রভাত ফেরীতে হাঁটা ছাড়া অন্য কোন সংস্কৃতি পালন করেছে কিনা জানি না। তবে এই দুটো সংস্কৃতির অংশ স্কুল কর্তৃপক্ষ বাধ্য করেছিল বলেই হয়তো।
জোনাকী প্রি-ক্যাডেট এন্ড হাই স্কুল এর প্রিন্সিপাল কিংবা জোনাকী স্কুল এর সাথে যারা সম্পৃক্ত ঠিক তারাই বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল সুস্থ ধারার মধ্য দিয়ে। এর পর অন্য কোন বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
সংস্কৃতি চর্চা কি শিক্ষার অনুষঙ্গ নয়? এর জন্য কি কোন বাজেট আসে না?
কিছু দিন আগে শুনলাম মুশুদ্দি মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে সেটাকে অনেকে যাত্রা পালার সাথে তুলনা করেছেন এর থেকে নাকি বেহুলা নাচও ভালো ছিলো।
সাংবাদিকদের কি আর বলব। এদের বলার মত কিছু নেই। পত্রিকা আমরাও পড়ি। আমাদের পাশের জামালপুর জেলার সরিষাবড়ির যত খবর পত্রিকায় আসে আমাদের ধনবাড়ির খবর এতোটা আসে না। সরিষাবাড়ি থেকে ধনবাড়িতে সাংবাদিক কম কিংবা ঘটনা কম? এ আমাকে বিশ্বাস করতে বলবেন না। ঘটনা আসবে কি করে এরা তো কেউ সাংবাদিক নয়, এরা সাংঘাতিক। টাকার খেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে বেকার হয়ে। তাদের কাজই হচ্ছে টাকা খেয়ে খবর ধাপাচাপা দেয়া।
সবাইকে আমি এক কাতারেও ফেলব না। তাই যদি হতো এই লেখাটা একজন সাংবাদিকও প্রকাশ করতো না তার পত্রিকায়। আর প্রকাশ না করলে হয়তো ধামাচাপা পরে যেত অন্য সব কিছুর মত। সাধুবাদ সেই সব সাংবাদিকদের জন্য যারা এখনো নিজের পেশাটাকেই সম্মান দিয়ে নিজের আসলে সসম্মানিত।
ইভটিজিং এর কথা না বলাই শ্রেয়। আমি আমার বাড়ির পেছনের রাস্তায় কাজেও দাঁড়াতে পারি না। তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলে গুলো বাইক হাকিয়ে যাচ্ছে আর ইভটিজিং করে যাচ্ছে সেই সাথে অটোরিক্সায় বসা ছেলেগুলোও কম যায় না। ইভটিজিং এর নমুনা গুলোও হাস্যকর। কি সব বাজে উচ্চারণ আর উল্লাস। এতো আনন্দ প্রকাশ নয়, এ হচ্ছে বিকৃত যৌনতা প্রকাশ। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি এদের বয়স আমার ছয় বছরের ব্যবধানের ছোট ভাইয়ের চেয়ে কম হবে না। এসব দেখে আমার ভয় হয়, বাসায় এসে ছোট ভাইকে শেখাই মেয়েদের শ্রদ্ধার জায়গাটা, রাস্তায় শিস বাজিয়ে চলা ছেলেগুলো বাজে কিংবা এসব একটা মেয়েকে কষ্ট দেয়। ও অন্তত বুঝুক ওর বোন এসব বিষয়ে কষ্ট পায়, ও শিখুক অন্য বোনেরাও এভাবে কষ্ট পায়।
ধনবাড়িতেও যাওয়া যায় না। সেই একই অবস্থা। ইভটিজিং। রাগে দুঃখে খুব প্রয়োজনে হাওয়ার বেগে বাইকে চলে যাই ধনবাড়ি যাতে কেউ দেখতে না পায় আমাকে আবার হাওয়ার বেগে চলে আসি। ধনবাড়িতে গেলে মনে হয় আমি অন্য গ্রহ থেকে আসছি আমি একটা এলিয়েন। আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে।
আমি বলছি না আমি মহা সুন্দরী, তবে এবার আমার ছোট্ট চাচাত বোন ঋতুকেও ধনবাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে ক্লাস সেভেনে পড়ে। কত বড় মেয়েই সে? আমি মানলাম আমি বড় মেয়ে বলে হয়তো এভাবে তাকায় কিন্তু ঋতুও রক্ষা পায় নি তাদের চোখের ধর্ষণ থেকে। তাহলে আপনি কাকে দোষ দেবেন? মেয়েকে নাকি ঐ লোকদের?
আমরা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন হারায় না, স্বপ্ন বার বার জেগে থাকে, আমরাও জেগে থাকি। একদল তরুণ যুবক যুবতী এখনো মুশুদ্দি নিয়ে চিন্তা করে ভাবে। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয় তবুও হারবার মত নয়। এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মেধা বিকাশ পাঠাগার, ধনবাড়ি ইয়ুথ ক্লাব, সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গন কিংবা শাইয়্যান ফাউন্ডেশনের মত অনেক প্রতিষ্ঠান। এরা আলো জ্বালিয়ে রাখে, আলোর পথ দেখায় আলোকবর্তিকা হয়ে।
উপরে উল্লেখিত সমস্যা শুধু একা আমার গ্রামের না, প্রায় সব গ্রামেই লক্ষ্য করা যায়। এই সব হাজার সমস্যা সমাধানের পথ একা বাতলে দেয়া সম্ভব না। প্রত্যেক এলাকার শিক্ষক, ছাত্র, স্থানীয় সরকার, সচেতন যুব সমাজ, সংবাদিক সবাই যদি একসাথে কাজ করার মনোবাসনা রাখে আমরা আলো দেখতে পাবোই।
আর আমরা বলতেই পারি স্বপ্ন আশা জাগিয়ে বুকে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে আগামী জেগে উঠবে বিস্ময়ে আলোর ফুলকিতে।
শুভ কামনা নতুন প্রভাতের জন্য।
জেনিস আক্তার
কবি ও কথা সাহিত্যিক।
মুশুদ্দি, ধনবাড়ি, টাঙ্গাইল থেকে।